পদার্থবিজ্ঞানে 'পরিমাপ' বিষয়টি কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ। "তোমরা হয়তো
নাক কুঁচকে ভাবছো, আরে ধুর! এটা আবার তেমন কিছু নাকি! একটা গজ ফিতে দিয়ে
এতদিন ধরে কত কি মেপে ফেললাম।"
আসলেই তাই আমাদের চারপাশের জিনিষপত্রগুলি গজফিতে, স্কেল, কম্পাস হাবিজাবি দিয়ে খুব সহজেই মেপে ফেলা যায়। এছাড়া তাপমাত্রা মাপার জন্য আমাদের রয়েছে থার্মোমিটার, সময় মাপার জন্য ঘড়ি, আর ভর[1] মাপার জন্য রয়েছে দাড়িপাল্লা।
আচ্ছা, প্রাচীনকালেতো ঘড়ি, দাড়িপাল্লা বা গজফিতে ছিলো না! তখন কি মানুষ মাপা-মাপি করতো না? অবশ্যই করতো। তবে তখন মানুষ পরিমাপের জন্য অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করতো।
যেমন সময় পরিমাপের জন্য তারা সূর্যের উপর নির্ভর করতো, সূর্য পূর্বে হেলে থাকলে সেটা সকাল, মাথার উপর থাকলে মধ্য দুপুর এভাবে করে তারা সম্পূর্ন দিনকে হিসাব করে নিতো।
আবার কোন কিছুর দৈর্ঘ্য মাপার জন্য দড়ি, লাঠি কোন কিছু দিয়ে সেটার পরিমাপ করার চেস্টা করতো।
প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে ইজিপ্টে দৈর্ঘ্য পরিমাপের জন্য তারা নিজেদের হাত, হাতের তালু অথবা আঙ্গুল ব্যবহার করতো। কিন্তু সমস্যা হল , সবার হাত বা হাতের তালুর দৈর্ঘ্যতো সমান নয়! এ সমস্যা দূর করার দায়িত্ব এসে পড়ে সেসময়ের ইজিপ্টের সম্রাট ফারাও এর ঘাড়ে।
উনি ঘোষনা করে দেন এখন থেকে রাজার হাতকে পরিমাপের আদর্শ হিসাবে ধরে নেওয়া হবে । এটা অবশ্য কোন অবাক করার মতো বিষয় নয়। সেসময়ে রাজা-রাজরাদের সবকিছুর মধ্যে নাকগলানোর অভ্যেস ছিলো। তাই সুযোগ বুঝে ইজিপ্টের সম্রাট নিজের 'হাত' দিয়ে 'একহাত' দেখে নিয়েছিলেন।
কিন্ত হাত নিয়ে হাতাহাতি তো সমাধান হতে পারেনা, তা যে সম্রাটের হাতই হোক। যাই হোক রাজারাজরাদের যুগ শেষ হবার পর জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা শলাপরামর্শ করে পরবর্তীতে মাপামাপির জন্য সারা বিশ্বে মোটামুটিভাবে তিন ধরনের পদ্ধতি চালু করেন।
১) এফ.পি.এস পদ্ধতি (দৈর্ঘ্যের একক ফুট, ভরের একক পাউন্ড আর সময়ের একক সেকেন্ড)
২) সি.জি.এস পদ্ধতি (দৈর্ঘ্যের একক সেন্টিমিটার, ভরের একক গ্রাম আর সময় হলো সেকেন্ড)
৩) এবং এম.কে.এস পদ্ধতি (দৈর্ঘ্য- মিটার, ভর- কিলোগ্রাম আর সময়ের একক ঐ সেকেন্ডই)
এই তিন ধরনের পরিমাপের পদ্ধতির মধ্যে সি.জি.এস পদ্ধতির প্রবর্তনকারী ছিলেন বিখ্যাত গণিতবীদ কার্ল ফ্রেডরিক গাউস।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মৌলিক রাশির এককসমূহঃ
এহেন তিন ধরনের একক থাকায় বিজ্ঞানীরা পরে গেলেন মহা মুশকিলে। দেখাগেলো একদেশে বিজ্ঞানীরা কোন কিছুকে একটি পদ্ধতিতে হিসাব করে রেখেছে, অন্যদেশের বিজ্ঞানীরা ঐ ফলাফলকে নিজের মত করে পরিবর্তন করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।
এসমস্যা থেকে মুক্তির জন্য ১৯৬০ সালে সব দেশে বিজ্ঞানীরা মহা সমাবেশ ডেকে আন্তর্জাতিকভাবে দৈর্ঘ্যের একক মিটার, ভরের একক কিলোগ্রাম এবং সময়ের একককে সেকেন্ড ধরে SI Unit (International System of Unit) ঘোষনা করে।
মৌলিক রাশির SI এককসমূহঃ
কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানেতো একমাত্রহ বস্তুর দৈর্ঘ্য, ভর বা ঘটনার সময় জানলেই চলেনা। এজন্য সব মিলিয়ে সাতটি মৌলিক রাশির জন্য সাতটি মৌলিক এককের ঘোষনা দেওয়া হয়।
SI এককগুলোর সংজ্ঞাঃ
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে SI Unit মোটামুটি এই মাপামাপির ক্যাচাল সমাধান করতে সক্ষম হয়। কিন্তু প্রশ্ন চলে আসে এই SI এককগুলো নির্ধারন করার উপায় কি? বৈজ্ঞানিকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সেগুলোরও একটা হিল্লে করে ফেলেন। আধুনিকভাবে সাতটি SI একককে সংজ্ঞায়িত করা হয় এভাবে-
দৈর্ঘ্যঃ বায়ুশূন্য স্থানে আলো সেকেন্ডে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে ১ মিটার বলে।
ভরঃ ফ্রান্সের International Burue of Weights and Measures এ সংরক্ষিত ইরিডিয়াম সংকর ধারুত তৈরির সিলিন্ডারের ভরকে আদর্শ এক কেজি ভর বলে ধরা হয়।
সময়ঃ একটি সিজিয়াম -১৩৩ পরমাণুর ৯১৯২৬৩১৭৭০ টি স্পন্দন সম্পন্ন করতে যে সময় লাগে তাকে ১ সেকেন্ড বলে।
তাপমাত্রাঃ পানির ত্রৈধ বিন্দুর তাপমাত্রার ভাগকে ১ কেলভিন বলে।
তড়িৎ প্রবাহঃ বায়ুশূন্য স্থানে এক মিটার দূরত্ব অবস্থিত অসীম দৈর্ঘ্যের এবং অতি ক্ষুদ্র প্রস্থচ্ছেদের দুটি সমান্তরাল সরল পরিবাহীর প্রত্যেকটিতে যে পরিমাণ তড়িৎ প্রবাহ চললে পরস্পরের মধ্যে প্রতি মিটার দৈর্গ্যে -- নিউটন বল উৎপন্ন হয় তাকে ১ অ্যাম্পিয়ার বলে।
দীপন ক্ষমতাঃ ১০১৩২৫ প্যাসকেল চাপে প্লাটিনামের হিমাঙ্কে (২০৪২ K) কোন কৃষ্ণ বস্তুর পৃষ্ঠের বর্গমিটার ক্ষেত্রেফলের পৃষ্ঠের অভিলম্ব বরাবর দীপন ক্ষমতাকে ১ ক্যান্ডেল বলে।
মোলঃ যে পরিমান পদার্থে ০.০১২ কেজি কার্বন এ অবস্থিত পরমাণুর সমান সংখ্যক প্রাথমিক ইউনিট থাকে তাকে ১ মোল বলে।
এখন পর্যন্ত এগুলোকেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একক বলে ধরা হয়। যদি বিভিন্ন দেশে এখনও নিজস্ব পরিমাপ পদ্ধতি চলে আসছে, তবুও বিজ্ঞান ও গবেষনার ক্ষেত্রে সবাই এই এককগুলোকেই ব্যবহার করে থাকে। পদার্থবিজ্ঞানেও গানিতিক সমস্যা সমাধান করার সময় আমরা এই এককগুলোই ব্যবহার করবো।
পদার্থবিজ্ঞানের
জটিল বিষয়গুলি আলোচনা করার সময় পরিমাপের এই ছোট ছোট বিষয়গুলো এসেই পরে। এই
অংশে এদের সম্পর্কে শুধুই প্রাথমিক ধারনা দেওয়া হলো। পরের অধ্যায়গুলোতে
আরও নাহয় আলোচনা করা যাবে। আজ এতটুকুই :)
---------------------------------------------------------------------------------------------
[1] যদিও আমরা অনেক সময় দোকানে গিয়ে 'চালের ওজন' , 'ডালের ওজন' বলে থাকি, কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় ওজনের সংজ্ঞা আসলে ভিন্ন। সঠিক শব্দটি হলো ভর।
আসলেই তাই আমাদের চারপাশের জিনিষপত্রগুলি গজফিতে, স্কেল, কম্পাস হাবিজাবি দিয়ে খুব সহজেই মেপে ফেলা যায়। এছাড়া তাপমাত্রা মাপার জন্য আমাদের রয়েছে থার্মোমিটার, সময় মাপার জন্য ঘড়ি, আর ভর[1] মাপার জন্য রয়েছে দাড়িপাল্লা।

আচ্ছা, প্রাচীনকালেতো ঘড়ি, দাড়িপাল্লা বা গজফিতে ছিলো না! তখন কি মানুষ মাপা-মাপি করতো না? অবশ্যই করতো। তবে তখন মানুষ পরিমাপের জন্য অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করতো।
যেমন সময় পরিমাপের জন্য তারা সূর্যের উপর নির্ভর করতো, সূর্য পূর্বে হেলে থাকলে সেটা সকাল, মাথার উপর থাকলে মধ্য দুপুর এভাবে করে তারা সম্পূর্ন দিনকে হিসাব করে নিতো।
আবার কোন কিছুর দৈর্ঘ্য মাপার জন্য দড়ি, লাঠি কোন কিছু দিয়ে সেটার পরিমাপ করার চেস্টা করতো।
![]() |
| অস্ট্রেলিয়ার অবস্থিত একটি পুরোন সূর্যঘড়ি |
প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে ইজিপ্টে দৈর্ঘ্য পরিমাপের জন্য তারা নিজেদের হাত, হাতের তালু অথবা আঙ্গুল ব্যবহার করতো। কিন্তু সমস্যা হল , সবার হাত বা হাতের তালুর দৈর্ঘ্যতো সমান নয়! এ সমস্যা দূর করার দায়িত্ব এসে পড়ে সেসময়ের ইজিপ্টের সম্রাট ফারাও এর ঘাড়ে।
উনি ঘোষনা করে দেন এখন থেকে রাজার হাতকে পরিমাপের আদর্শ হিসাবে ধরে নেওয়া হবে । এটা অবশ্য কোন অবাক করার মতো বিষয় নয়। সেসময়ে রাজা-রাজরাদের সবকিছুর মধ্যে নাকগলানোর অভ্যেস ছিলো। তাই সুযোগ বুঝে ইজিপ্টের সম্রাট নিজের 'হাত' দিয়ে 'একহাত' দেখে নিয়েছিলেন।
কিন্ত হাত নিয়ে হাতাহাতি তো সমাধান হতে পারেনা, তা যে সম্রাটের হাতই হোক। যাই হোক রাজারাজরাদের যুগ শেষ হবার পর জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা শলাপরামর্শ করে পরবর্তীতে মাপামাপির জন্য সারা বিশ্বে মোটামুটিভাবে তিন ধরনের পদ্ধতি চালু করেন।
১) এফ.পি.এস পদ্ধতি (দৈর্ঘ্যের একক ফুট, ভরের একক পাউন্ড আর সময়ের একক সেকেন্ড)
২) সি.জি.এস পদ্ধতি (দৈর্ঘ্যের একক সেন্টিমিটার, ভরের একক গ্রাম আর সময় হলো সেকেন্ড)
৩) এবং এম.কে.এস পদ্ধতি (দৈর্ঘ্য- মিটার, ভর- কিলোগ্রাম আর সময়ের একক ঐ সেকেন্ডই)
এই তিন ধরনের পরিমাপের পদ্ধতির মধ্যে সি.জি.এস পদ্ধতির প্রবর্তনকারী ছিলেন বিখ্যাত গণিতবীদ কার্ল ফ্রেডরিক গাউস।
![]() |
| Carl Friedrich Gauss |
আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মৌলিক রাশির এককসমূহঃ
এহেন তিন ধরনের একক থাকায় বিজ্ঞানীরা পরে গেলেন মহা মুশকিলে। দেখাগেলো একদেশে বিজ্ঞানীরা কোন কিছুকে একটি পদ্ধতিতে হিসাব করে রেখেছে, অন্যদেশের বিজ্ঞানীরা ঐ ফলাফলকে নিজের মত করে পরিবর্তন করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।
এসমস্যা থেকে মুক্তির জন্য ১৯৬০ সালে সব দেশে বিজ্ঞানীরা মহা সমাবেশ ডেকে আন্তর্জাতিকভাবে দৈর্ঘ্যের একক মিটার, ভরের একক কিলোগ্রাম এবং সময়ের একককে সেকেন্ড ধরে SI Unit (International System of Unit) ঘোষনা করে।
মৌলিক রাশির SI এককসমূহঃ
কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানেতো একমাত্রহ বস্তুর দৈর্ঘ্য, ভর বা ঘটনার সময় জানলেই চলেনা। এজন্য সব মিলিয়ে সাতটি মৌলিক রাশির জন্য সাতটি মৌলিক এককের ঘোষনা দেওয়া হয়।
| রাশির নাম ও প্রতীক | SI একক ও প্রতীক | CGS একক ও প্রতীক |
| দৈর্ঘ্য (l) | মিটার (m) | সেন্টিমিটার (cm) |
| সময় (t) | সেকেন্ড (s) | সেকেন্ড (s) |
| ভর (m) | কিলোগ্রাম (kg) | গ্রাম (g) |
| তড়িৎ প্রবাহ (I) | অ্যাম্পিয়ার (A) | অ্যাম্পিয়ার (A) |
| তাপমাত্রা ($ \theta$,T) | কেলভিন (K) | সেলসিয়ার (°C) |
| পদার্থের পরিমান (n) | মোল (mol) | মোল (mol) |
| দীপন ক্ষমতা (I) | ক্যান্ডেলা (Cd) | ক্যান্ডেল পাওয়ার (cp) |
![]() |
| SI units |
SI এককগুলোর সংজ্ঞাঃ
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে SI Unit মোটামুটি এই মাপামাপির ক্যাচাল সমাধান করতে সক্ষম হয়। কিন্তু প্রশ্ন চলে আসে এই SI এককগুলো নির্ধারন করার উপায় কি? বৈজ্ঞানিকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সেগুলোরও একটা হিল্লে করে ফেলেন। আধুনিকভাবে সাতটি SI একককে সংজ্ঞায়িত করা হয় এভাবে-
ভরঃ ফ্রান্সের International Burue of Weights and Measures এ সংরক্ষিত ইরিডিয়াম সংকর ধারুত তৈরির সিলিন্ডারের ভরকে আদর্শ এক কেজি ভর বলে ধরা হয়।
সময়ঃ একটি সিজিয়াম -১৩৩ পরমাণুর ৯১৯২৬৩১৭৭০ টি স্পন্দন সম্পন্ন করতে যে সময় লাগে তাকে ১ সেকেন্ড বলে।
তাপমাত্রাঃ পানির ত্রৈধ বিন্দুর তাপমাত্রার ভাগকে ১ কেলভিন বলে।
তড়িৎ প্রবাহঃ বায়ুশূন্য স্থানে এক মিটার দূরত্ব অবস্থিত অসীম দৈর্ঘ্যের এবং অতি ক্ষুদ্র প্রস্থচ্ছেদের দুটি সমান্তরাল সরল পরিবাহীর প্রত্যেকটিতে যে পরিমাণ তড়িৎ প্রবাহ চললে পরস্পরের মধ্যে প্রতি মিটার দৈর্গ্যে -- নিউটন বল উৎপন্ন হয় তাকে ১ অ্যাম্পিয়ার বলে।
দীপন ক্ষমতাঃ ১০১৩২৫ প্যাসকেল চাপে প্লাটিনামের হিমাঙ্কে (২০৪২ K) কোন কৃষ্ণ বস্তুর পৃষ্ঠের বর্গমিটার ক্ষেত্রেফলের পৃষ্ঠের অভিলম্ব বরাবর দীপন ক্ষমতাকে ১ ক্যান্ডেল বলে।
মোলঃ যে পরিমান পদার্থে ০.০১২ কেজি কার্বন এ অবস্থিত পরমাণুর সমান সংখ্যক প্রাথমিক ইউনিট থাকে তাকে ১ মোল বলে।
এখন পর্যন্ত এগুলোকেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একক বলে ধরা হয়। যদি বিভিন্ন দেশে এখনও নিজস্ব পরিমাপ পদ্ধতি চলে আসছে, তবুও বিজ্ঞান ও গবেষনার ক্ষেত্রে সবাই এই এককগুলোকেই ব্যবহার করে থাকে। পদার্থবিজ্ঞানেও গানিতিক সমস্যা সমাধান করার সময় আমরা এই এককগুলোই ব্যবহার করবো।
---------------------------------------------------------------------------------------------
[1] যদিও আমরা অনেক সময় দোকানে গিয়ে 'চালের ওজন' , 'ডালের ওজন' বলে থাকি, কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় ওজনের সংজ্ঞা আসলে ভিন্ন। সঠিক শব্দটি হলো ভর।




